অলি আউলিয়ার দেশ বাংলাদেশ। বারো আউলিয়ার চট্টগ্রাম ও পুণ্যভূমি সিলেট ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য মুসলিম স্থাপত্য, পীর-মাশায়েখের দরগা-মাজার। এ দেশের ৯২ শতাংশ মানুষের ধর্ম ইসলাম। তবে সাম্প্রদায়িক স¤প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রচুর ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে। প্রায় দেড় হাজার ধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ দর্শনীয় স্থান থাকলেও তার অনেকই এখনো বিশ্ববাসীর অজানা। যেগুলোর আকর্ষণ বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। ঐতিহাসিক ওইসব স্থাপনা দেখতে প্রচুর সংখ্যায় বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে ভ্রমণ করেন। যদিও সব কিছুই পরিকল্পনা ছাড়াই চলছে। গত বছর দশম ইসলামিক কনফারেন্স অব ট্যুরিজম মিনিস্টার্সের সভায় ২০১৯ সালে ঢাকাকে ওআইসি পর্যটন নগরী ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে গত ১১-১২ জুলাই এ অর্জনকে উদযাপনও করা হয়। ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ওআইসি এ জন্য ১৩০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে পর্যটক আকর্ষণে ব্যর্থ হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভুটান ও নেপাল অনেকটা এগিয়ে। তাই ওআইসি’র সহযোগিতা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যতে পারলে বাংলাদেশের ধর্মীয় স্থাপনাগুলোও বিশ্বের অন্যতম পর্যটন গন্তব্য হতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। হালনাগাদ সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এটা অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশে ধর্মীয় স্থানে ভ্রমণে আগ্রহী পর্যটকের সংখ্যা কম নয়। তবে পর্যটক আকর্ষণে আরও প্রচারণা ও পরিকল্পনামাফিক আগানোর কথা বললেন তারা। এমনকি মানবতার ধর্ম ইসলামেও পর্যটনের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। রয়েছে ইসলামে ভ্রমণের নির্দেশনা। ইসলাম মনে করে, ভ্রমণ হতে পারে ইবাদত, বিনোদন বা ব্যবসার উদ্দেশ্যে।
ভ্রমণকে বলা হয় জ্ঞানসমুদ্রের সন্ধান। হাজারো কর্মব্যস্ততার মাঝে শরীর ও মনের সুস্থতার জন্য এবং জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে ছোট-বড়, ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে দেশ ভ্রমণ প্রতিটি মানুষের জন্যই প্রয়োজন। এ ছাড়া ভ্রমণের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অধিবাসী ও স¤প্রদায়ের সঙ্গে পরস্পর সেতুবন্ধন রচিত হয়। পারস্পরিক সহনশীলতা, সামাজিক রীতি-নীতি, সাংস্কৃতিক ভাব, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং অর্থনৈতিক চিন্তাধারা নিয়ে নানা জ্ঞান আদান-প্রদানের সুযোগ ঘটে।
সূত্র মতে, ভবিষ্যতে বিশ্বের পর্যটকদের কাছে অন্যতম পছন্দের গন্তব্য হবে বাংলাদেশ। ঢাকাকে ওআইসি’র পর্যটন নগরী ঘোষণা করা এবং ১৩০ কোটি টাকার সহযোগিতায় ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলোর সংস্কার ও সজ্জিতকরণ সম্ভব হবে। এতে ওআইসি সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন ঘটবে। ঢাকার পর্যটনগত ধর্মীয় গুরুত্ব বাড়বে, বাড়বে ঢাকা ভ্রমণের আগ্রহ। এর আগে ওআইসি’র অঙ্গসংগঠন ইসলামিক এডুকেশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন ২০১২ সালের জন্য ঢাকাকে ইসলামী সংস্কৃতির এশীয় অঞ্চলের রাজধানী ঘোষণা করে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব ও ঢাকার মর্যাদা তৈরি করেছে। এরই অংশ হিসেবে ধর্মীয় স্থানকেন্দ্রিক ‘হালাল’ পর্যটন জোরদারে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ, তুরস্ক ও ইরান। সউদী আরবও ধর্মীয় পর্যটন বাড়ানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। আগামী ৭ থেকে ৯ অক্টোবর তিন দিনব্যাপী ওআইসি’র অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইসলামিক সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অব ট্রেড (আইসিডিটি) অনলাইন ইকো ট্যুরিজম ওয়ার্কশপের উদ্যোগ নিয়েছে।
ভ্রমণপিপাসু অধিকাংশ বাংলাদেশীদের মতে, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থানগুলোকে সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। শুধু ঢাকাতেই এমন প্রচুর ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে, যেগুলো পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমজিদ বায়তুল মোকাররমের অবস্থান। ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ঐতিহ্যে এ মসজিদের অবস্থান শীর্ষে। এ ছাড়াও ঢাকার নামকরা আরও বেশ কিছু মসজিদ রয়েছে। সেগুলো হলো- লালবাগ শাহী মসজিদ, বেগম বাজার শাহী মসজিদ, গুলশান আজাদ মসজিদ, কসাইটুলি মসজিদ, খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ, হাইকোর্ট মাজার মসজিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ, মোহাম্মদপুর সাতমসজিদ, তারা মসজিদ, মুসা খাঁ মসজিদ, লালবাগ দুর্গ মসজিদ, বিনত বিবির মসজিদ, কাওরান বাজারের আম্বরশাহ মসজিদ ও গোলাপ শাহ মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ।
ঢাকার বাইরে অনুপম ও আকর্ষণীয় স্থাপত্যরীতির মসজিদগুলোর মধ্যে রয়েছে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, টাঙ্গাইলের আতিয়া মসজিদ, বরিশালের বায়তুল আমান মসজিদ, চট্টগ্রামের চন্দনপুরা মসজিদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সোনা মসজিদ, নোয়াখালীর বজরা শাহী মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ।
মসজিদ ছাড়া বিখ্যাত মাজার ও দরগার মাঝে রয়েছে সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজার ও হজরত শাহ পরানের মাজার। চট্টগ্রামে হজরত বায়েজিদ বোস্তামির মাজার ও হজরত শাহ আমানতের দরগা শরিফ। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর সুফি-দরবেশদের মাজার ছড়িয়ে আছে। এসব দরবারে সারা বছর বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিল হয়, যেখানে লাখ লাখ মানুষ একত্রিত হয়। সেখানেও প্রচুর সংখ্যায় বিদেশি আগমন করে থাকেন।
বাংলাদেশের অপূর্ব সুন্দর শিল্প অনুপম স্থাপত্যের নিদর্শন, যা দেশ-বিদেশের বহু পর্যটককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। ধর্মীয় উৎসব এ দেশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে, যা বিদ্যমান পর্যটন আকর্ষণের সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করে অধিক পর্যটক আকৃষ্ট করতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশে প্রতি বছর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গির তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত হয়। এ বিশ্ব ইজতেমায় দেশের লাখো মুসল্লির সঙ্গে পৃথিবীর প্রায় শতাধিক দেশের বিদেশি মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে রয়েছে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, রমজান মাস, শবে বরাত, শবে কদর ও আশুরাসহ বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল। এসব ধর্মীয় উৎসবই যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে আনন্দ উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করা হয়, যা পর্যটকদের এদেশের সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে পর্যটনের যাবতীয় প্রচারাভিযানে ঐতিহ্যমন্ডিত ও ধর্মীয় স্থাপনাগুলোকেও গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করতে হবে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর প্রচার করতে হবে।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) পরিচালক তৌফিক রহমান বলেন, ধর্মীয় কারণ ছাড়াও উৎসবকে কেন্দ্র করে পর্যটকরা আসছেন। তিনি বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি বছর ইংল্যান্ড, চীন, থাইল্যান্ড থেকে খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের বহু পর্যটক বাংলাদেশে আসেন ঈদ, ইজতেমা ও রাসমেলা দেখতে। তারা এখানে ধর্মীয় কারণে নয়, বরং এসব উৎসব দেখতে আসেন। ঈদে মানুষ ট্রেনে যেভাবে যান, ইজতেমায় এত মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় ও পয়লা বৈশাখে শোভাযাত্রাও দেখতে তারা আসেন।
বাংলাদেশে ধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ প্রায় দেড় হাজার স্থান থাকলেও তার অনেকই এখনো বিশ্ববাসীর অজানা। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) ফাউজুল কবীর মঈন ইনকিলাবকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা ধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানে পর্যটনের প্রসার ঘটাতে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে মহাপরিকল্পনাও করছে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড। ইতোমধ্যে ওআইসি’র পরিকল্পনা অনুযায়ী ডিটেইল প্রজেক্ট প্লান (ডিপিপি) পাঠানো হয়েছে। ওআইসি টাকা ছাড় করলেই ধর্মীয় স্থাপনাগুলো সংস্কার ও সজ্জিতকরণ কার্যক্রম শুরু হবে।
বিভিন্ন জরিপ বলছে, বিশ্বজুড়ে মুসলিম পর্যটকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাই ধর্মীয় স্থানগুলোতে পর্যটন শুরু হলে আগামী পাঁচ বছরে এই খাতে বছরে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা আয় হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পর্যটন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানের পর্যটন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হয়ে উঠতে পারে দেশের আয়ের অন্যতম খাত। কারণ, দেশে ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থাপনার অভাব নেই। সুলতানি আমল থেকে শুরু করে মোগল আমলের অনেক মুসলিম ধর্মীয় স্থাপত্যকীর্তি রয়েছে এখানে। এ ছাড়া বৌদ্ধ ধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান যেমন পাহাড়পুর বিহার, ময়নামতি বিহার, বান্দরবানের স্বর্ণমন্দিরসহ আরও ছোট ছোট স্থাপনা এখন পর্যটনের নতুন আকর্ষণ।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পর্যটন গবেষক শারমিন সুলতানার মতে, বাংলাদেশে ধর্মীয় ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। মসজিদগুলো পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। অন্যদিকে বাংলাদেশে হয় বিশ্ব ইজতেমা। এতেও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। এ জন্য তিনি ভিসা জটিলতা দূর ও বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিংয়ে গুরুত্ব দেয়ার সুপারিশ করেছেন।
অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, বিশ্বে ৫৭টির মতো মুসলিম দেশে ১৬০ কোটি মুসলমান রয়েছেন। মুসলিম ঐতিহ্য দর্শনে আগ্রহী এ জনগোষ্ঠীকে ভ্রমণে উৎসাহিত করার মাধ্যমে পর্যটন বিকাশের সুযোগ থাকছে বাংলাদেশের। তার মতে, বিষয়টি হচ্ছে একটি শহরকে ফোকাস করা এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামী কৃষ্টি-সংস্কৃতির গুরুত্ব বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী ড. ভুবন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, বিভিন্ন উৎসবকেন্দ্রিক পর্যটন গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প নতুন সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই পর্যটন বিকাশে মহাপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। ধর্মীয় ঐতিহাসিক স্থান ও প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শনগুলো পর্যটন উপযোগী করতে ধর্ম ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছে। ধর্মীয় ও হালাল পর্যটন বাড়াতে আমরা ইতোমধ্যে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে কাজ শুরু করেছি।